*আরব্য রজনীর অজানার অধ্যায় থেকে :
লেখকের মুখবন্ধ
আমি কখনোই ভালোভাবে ফান্ড করা কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার হয়ে কাজ করিনি। মূলধারার জাতীয় কোনো মিডিয়াতেও আমি কাজ করিনি। সবসময়ই আমার সম্পর্ক ছিল বিকল্প ধারার মিডিয়ার (Alternative Media) সাথে। ফলে কখনোই আমার হাতে অনেক অনেক অপশন থাকতো না। বরং খুবই সংকীর্ণ পরিসরে আমাকে কাজ করতে হতো। রাজনৈতিক ময়দানের গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ ব্যক্তিত্বরা তাদের মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য ভালো ফান্ডিং সম্বলিত মূলধারার সংবাদ সংস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে থাকে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সাধারণ মিডিয়ার তুলনায় ভিন্নধর্মী মিডিয়ার লোকদেরকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়।
তবে ভিন্নধর্মী মিডিয়ার জন্য স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করাই আমার মন-মেজাজের সাথে যায়। কারণ কাজের এই ধরনটি ‘প্রচলিত ধ্যানধারণার’ বাইরে এসে সত্য উদঘাটন করতে উৎসাহিত করে। ফলে আমি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হই। উদাহরণস্বরূপ, আমি আল-কায়েদার সুপরিচিত পরিমণ্ডলের ব্যক্তিদের নিয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক চিন্তার বদলে আল-কায়েদার সাংগঠনিক কাঠামোর নিচের ধাপে অবস্থিত লোকদের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা, তাদের জীবন, পর্দার আড়ালে তাদের অবদান – যেগুলো বাস্তবে একটি আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণ করে চলেছে, তা অন্যদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। সেই স্বল্প পরিচিত মানুষদের যাদের ব্যাপারে আমি গবেষণা করেছি এবং যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের মধ্যে রয়েছেন কমান্ডার মুহাম্মাদ ইলিয়াস কাশ্মীরি, সিরাজউদ্দিন হাক্কানি এবং কারী জিয়াউর রহমান। (তাঁরা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে আন্দোলনের প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।)
উসামা বিন লাদেনকে আজকের দুনিয়া চেনে এমন এক ব্যক্তি হিসেবে, যিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছিলেন; আর আল-কায়েদা হলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এই আন্দোলনের কার্যকরী প্রতিরূপ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিন লাদেন ছাড়াও আল-কায়েদার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। আল-কায়েদার এই কাহিনীতে ঠিক সেই পরিমাণ চরিত্র, ব্যক্তি এবং চমক রয়েছে যা রানী শেহেরজাদে তার স্বামী বাদশাহ শাহরিয়ারকে কিংবদন্তীতুল্য রূপকথা ‘আলিফ লায়লা’-এর গল্পে বর্ণনা করেছিল। এই কাহিনীগুলোতে এমন অনেক স্বল্প পরিচিত চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজেদের সময়কার দুনিয়াকে প্রভাবিত করেছিল ঐ ধরনের ভালোবাসা অথবা বিশ্বস্ততা দ্বারা, যেগুলোকে আজও মানবতার নির্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়।
আলিফ-লায়লা তথা আরব্য রজনী হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে প্রচলিত অনেকগুলো গল্প ও লোককাহিনী, যা ইসলামি স্বর্ণযুগে আরবিতে সংকলিত হয়েছিল। এই গল্পগুলোর লেখক এবং সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। চরিত্রহীনা প্রথম স্ত্রীর প্রতারণার স্বীকার হওয়ার পর রাজা শাহরিয়ার ছলনাময়ী নারীত্বকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিদিন একজন নতুন নারীকে বিয়ে ও বাসর রাতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শাহরিয়ারের সেই প্রতিশোধস্পৃহায় আরব্য রজনীর গল্পগুলো একসূত্রে গাঁথা। চতুর শেহেরজাদে, যাকে ভারতীয় বংশদ্ভূত বলে ধারণা করা হয় – সেটার সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। এক হাজার এক রাতব্যাপী বিস্তৃত গল্পের মাধ্যমে সে শাহরিয়ারকে বিমোহিত করে রেখেছিল যাতে করে মৃত্যু এড়ানো যায়, এবং রাজার মনে নারী জাতির প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে।
শেহেরজাদের এই গল্পগাঁথা জুড়ে ছিল ভারত, ইরাক, ইরান, মিশর, তুর্কি এবং খুব সম্ভবত গ্রিসের বিভিন্ন গল্প। ধারণা করা হয় যে, সেই গল্পগুলো প্রাথমিকভাবে মুখেমুখে প্রচারিত হয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে শতাব্দীজুড়ে সেগুলো এক সমন্বিত রূপ লাভ করে। গল্পগুলোর মতোই এই সংকলনের ইতিহাসও দীর্ঘ, জটিল এবং আঁকাবাঁকা। আর এই গল্পগুলোও জটিল আর চমকপ্রদ বর্ণনে পাঠককে এমন এক মনোমুগ্ধকর কাহিনীর ঘোরপাকে নিয়ে যায়, যা থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। আমি চেষ্টা করেছি আল-কায়েদার নিজস্ব আরব্য রজনীর গল্পের কিংবদন্তীতুল্য কিছু চরিত্রের পেছনের রহস্য উন্মোচন করে সমান্তরালভাবে উস্থাপন করার। এগুলো হচ্ছে সেই সব চরিত্রের গল্প, যারা পর্দার আড়ালে কাজ করেছেন। আবার একই সময়ে তারা এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যার ফলে ২০০১-এ আমেরিকায় হামলার পর যাদের ব্যাপারে ধারণা করা হচ্ছিল যে তোরা-বোরা পাহাড়ের ধ্বংসস্তুপের নিচে তারা চাপা পড়ে গেছে, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কিনা সেই আল-কায়েদা উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্যএশিয়া পর্যন্ত তাদের ডানা বিস্তৃত করেছে; পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি বাস্তবমুখী এবং বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়েছে।
আল-কায়েদার বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করবার জন্য আমি ইরাক, লেবানন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান এবং আফগানিস্তান ভ্রমণ করেছি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমার প্রকৃত অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে খুবই স্বল্প পরিচিত একজন মানুষ। পাকিস্তানের এলিট কমান্ডোদের একজন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (SSG) সদস্য রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন খুররম আশিক । যখন আমি তাঁর সাথে দেখা করি, ততদিনে ক্যাপ্টেন খুররম সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে যোগ দিয়েছেন।
আল-কায়েদাতে খুররামের অবদান ভোলার মতো ছিল না। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর বন্ধু রিটায়ার্ড মেজর আবদুর রহমান এবং তাঁর ভাই রিটায়ার্ড মেজর হারুণ, আমার সাথে দেখা করেন এবং আল-কায়েদার যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাকে আরও বিস্তৃত করেন। দুই রিটায়ার্ড মেজর আবদুর রহমান এবং মেজর হারুণ পরবর্তীতে ২৬ নভেম্বর, ২০০৮-এর মুম্বাই হামলার (যে হামলাকে ২৬/১১ বলা হয়) প্রধান দুই মাস্টারমাইন্ডে পরিণত হন এবং পশ্চিমাদের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
তাঁদের সাথে দেখা হওয়ার পর সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি আল-কায়েদার দুনিয়াকে দেখা শুরু করি – এক অতুলনীয় কর্মশক্তি যা কেবল বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল, উন্নত এবং শক্তিশালী প্রযুক্তির আমেরিকাকে (বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার) ৯/১১-এর মাধ্যমে উস্কে দিয়েছিল। তাদের এই চালের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকাকে এমন এক অঞ্চলে যুদ্ধে টেনে আনা, যেখানকার মানুষেরা রীতিমত প্রস্তর যুগে বসবাস করতো – এমন এক যুগ, যেখানে উন্নত প্রযুক্তির কোনোই মূল্য নেই, যেখানে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত জ্ঞানটুকুই বিদ্যমান। তাই এটি বিস্ময়কর নয় যে, এই যুদ্ধের শুরুর দিকে আল-কায়েদার অনুগত শত শত যোদ্ধা নিহত হয়েছিল; আর বেঁচে যাওয়া যোদ্ধারা দ্রুত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল; বাধ্য হয়েছিল আমেরিকার বিজয় পর্যবেক্ষণে। যখন স্থানীয় তালেবান যোদ্ধারা বিদেশি আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তখন আল-কায়েদা খুব গভীরভাবে পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করলেও প্রাথমিকভাবে লড়াই থেকে ছিল বিরত। বরং তারা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত ছিল অন্য এক কাজে, আর তা হলো এই স্থানীয়দেরকে রক্তের ভাইয়ে পরিণত করা, এবং আল-কায়েদার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। আল-কায়েদার প্রথম লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের মাটিতে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা। পরবর্তী লক্ষ্য ছিল যুদ্ধকে মধ্যএশিয়া থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করা, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের চূড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগেই (বিশ্বের বাকি থাকা একমাত্র) সুপার পাওয়ারের শক্তি সামর্থ্য ও সম্পদকে নিঃশেষ করে দেওয়া যায়; যাতে পরবর্তীতে খিলাফাতের অধীনে মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংগত করা যায়, যা পরবর্তীতে সকল মুসলিম ভূমিগুলোকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করবে। এই বইটি এমনই এক সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে লেখা হয়েছে, যখন আফগানিস্তানে পশ্চিমা মিত্রশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সময়ে অনেক বক্তাই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনপুষ্ট এক আল-কায়েদার ছবি এঁকে, বিশ্ববাসীর জন্য একে হুমকি হিসেবে চিত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু বহু বছরের যুদ্ধের পর যা সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে, তা হলো কারও সমর্থন কিংবা অস্ত্রশস্ত্রই আল-কায়েদার সাফল্যের চাবি ছিল না। বরং আল-কায়েদার সাফল্যের চাবি ছিল – চলমান ঘটনাপ্রবাহকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উন্নত-প্রযুক্তিসম্পন্ন শত্রুকে বিপর্যস্ত করার ভয়ঙ্কর এক কৌশলি ক্ষমতা। পশ্চিমা মিত্রশক্তি এখন আফগান যুদ্ধের ময়দান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছে। কিন্তু কখনও যদি পশ্চিমা মিত্রশক্তি তা করতে সক্ষম হয়ও, তবুও এর মাধ্যমে পশ্চিমের বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে না। বরং এটা যুদ্ধের কেবলমাত্র একটি পর্বের সমাপ্তির সংকেত দেবে, এবং আরেকটি পর্বের সূচনা করবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটিই আমি পুরো বইটি জুড়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
*সাম্রাজ্যের ত্রাস থেকে :
মাইকেল শইয়ারের (Michael Scheuer) জন্ম ১৯৫২ সালে নিউ ইয়র্কে। তার পরিচয় একাধারে ব্লগার, লেখক, আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির সমালোচক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শান্তি ও সুরক্ষা’ কেন্দ্রের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিচয়টি হলো তিনি আমেরিকার কেন্দ্রীয় গো য়ে ন্দা সংস্থা C I A-এর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা। ত্রিশ বছর বয়সে যোগদানের পর থেকে ২০০৪ সালে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত প্রায় ২২ বছর C I A-তে কাজ করেছেন। আর এই ক্যারিয়ারেও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত C I A-এর কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টারে ‘বি ন লা দে ন ইস্যু ইউনিট’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একই ইউনিটের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। ‘বি ন লা দে ন ইস্যু ইউনিট’ কিংবা অন্য নামে A l e c Station ছিল উ সা মা বি ন লা দে ন কে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য আমেরিকার গোয়েন্দাদের বিশেষায়িত দল।
.
‘বি ন লা দে ন ই স্যু ই উ নি ট’-এ কাজ করার পুরো সময় জুড়ে উ সা মা বি ন লা দে ন, আ ল-কা য়ে দা এবং এর মিত্রদের ব্যাপারে অধ্যয়ন করে মাইকেল শইয়ার বেশকিছু উপলব্ধিতে পৌঁছান। এভাবে চলতে চলতে এক সময় নিজের সেই উপলব্ধিগুলো তিনি আমেরিকানদের কাছে পৌঁছে দেওয়ারও তাগিদ অনুভব করেন। সেই তাগিদ থেকে বইও লিখতে শুরু করেন। কিন্তু একইসাথে তৎকালীন পরিস্থিতিতে নিজের উপলব্ধিগুলো ভয়ঙ্করভাবে স্রোতের বিপরীত অনুভব করে শইয়ার প্রথম প্রথম নিজের বই নাম গোপন করে প্রকাশ করেন। এভাবে ২০০২ সালে তাঁর T h r o u g h O u r E n e m i e s’ E y e s এবং ২০০৪ সালে I m p e r i a l H u b r i s : Why the West Is Losing the W a r on T e r r o r প্রকাশিত হয়।
.
বইগুলোতে তিনি মূলত আমেরিকার ইসলামপন্থী শত্রুদের ব্যাপারে নিজ মাতৃভূমির নীতি নির্ধারকদের ভুল ধারণার সমালোচনা করেন। এছাড়া আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক আগ্রাসনের সমালোচনা করে শইয়ার ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আমেরিকা আ ল – কা য়ে দার ফাঁদে পা দিয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে আমেরিকার অর্থনীতি অচিরেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে। ২০০৪ সালে C I A থেকে পদত্যাগ করার পরপরই তিনি বইগুলোর লেখক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। এভাবেই মাইকেল শইয়ার আমেরিকার যুদ্ধ ও রাজনীতি, ইসলামপন্থীদের আদর্শ ও কর্মপন্থার একজন মৌলিক ও প্রামাণ্য চিন্তাবিদ হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
.
পরবর্তীতে মাইকেল শইয়ারের আরও দুটো একক বই Marching Toward Hell: America and Islam After I r a q (২০০৮) এবং O s a m a B i n L a d e n (২০১১) প্রকাশিত হয়। এই বইগুলোতে শইয়ার তার উপলব্ধি ও বর্ণনাকে প্রাণবন্ত করার পাশাপাশি আরও দালিলিক প্রমাণ দিয়ে বলিষ্ঠ করে তোলেন। এখনও পর্যন্ত মাইকেল শইয়ারের একক মৌলিক বই চারটি হলেও পরবর্তীতে আরও বেশ কয়েকটি বইয়ের সহলেখক হিসেবেও কাজ করেছেন। শইয়ারের সর্বশেষ একক বই O s a m a B i n L a d e n বাংলা ভাষায় ‘সাম্রাজ্যের ত্রাস’ (২০২১) নামে প্রকাশিত হয়।
.
আন্তর্জাতিক জি হা দি সংগঠন আ ল-কা য়ে দা র আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিহাসের একেবারে মৌলিক উৎসগুলো নিয়ে মাইকেল শইয়ার যেভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন, তা এক কথায় বিরল। তার কাজ প্রকাশ্যে আসার পর থেকে দেশ-বিদেশের শিক্ষিত চিন্তাশীল মহলের মানুষদের বাহবার পাশাপাশি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক মূল্যায়নও তিনি পেয়েছেন। আর সেটা হলো, স্বয়ং আ ল-কা য়ে দা নেতা উ সা মা বি ন লা দে নে র মূল্যায়ন। ২০০৭ সালের একটি বক্তব্যে উ সা মা বি ন লা দে ন আমেরিকানদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তোমরা যদি জানতে চাও যে আসলে কী ঘটছে, কেন তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, তাহলে উচিত হবে মাইকেল শইয়ারের বই পড়ে দেখা।” কিন্তু নিজেদের লোকের রেফারেন্স পেয়েও আমেরিকার নীতি নির্ধারকরা স্বভাবসুলভ ঔদ্ধত্য বজায় রেখেছিল, আরও ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। হয়তো রেফারেন্স শত্রুর মুখে পেয়েছিল বলেই আমেরিকা তখন এমন আচরণ করেছিল।
.
মাইকেল শইয়ারের সত্যান্বেষণ এবং লিখালিখির ময়দানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা যায় লরেন্স রাইটকে (Lawrence Wright)। লরেন্স রাইট ২০০৬ সালে তার লিখা The Looming Tower: A l –Q a e d a and the Road to 9 / 1 1 বইয়ের জন্য খ্যাতি পান। এমনকি ২০০৭ সালে বইটির পুলিৎজার পুরস্কারও জেতেন। কিন্তু লরেন্স রাইট তার বইতে আ ল-কা য়ে দা বিশেষ করে উ সা মা বি ন লা দে নের উত্থানের যে ন্যারেটিভ বর্ণনা করেছেন, সেটিকে পরবর্তীতে মাইকেল শইয়ার তার ২০১১ সালের O s a m a B i n L a d e n বইতে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একেবারে বানচাল করে দেন। সেই সাথে শইয়ার দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে লরেন্স রাইটের মতো লেখকরা সময়ের জনপ্রিয় স্রোতে গা ভাসিয়ে তথ্য খুঁজতে নামে বলেই এমন কাজগুলোকে রীতিমতো পূজা করা হয়, এমনকি আমেরিকার মতো পরাশক্তি নিজেকে ধোঁকার মধ্যে ডুবিয়ে রাখার সুযোগ পায়। এভাবে লরেন্স রাইটের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কাজকেই মাইকেল শইয়ার প্রশ্নবিদ্ধ করে দেন।
.
স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে শইয়ার শত্রুকে সত্যিকার রূপে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন ঠিক। তবে এখানে ভুল বোঝারও কোনো অবকাশ নেই। তার সমস্ত অধ্যয়ন, সমস্ত প্রচেষ্টা ছিল নিজ মাতৃভূমিকে শত্রুর ফাঁদে পা দেওয়া থেকে বাঁচানো। অবশ্য আমেরিকার নীতি নির্ধারকরা সেই পথে হাঁটেনি। দিনশেষে নিজের উপলব্ধিগুলো যে আমেরিকাকে বোঝাতেই মাইকেল শইয়ার এত পরিশ্রম করেছিলেন, এত বাক্য ব্যয় করেছিলেন, সে আমেরিকাই তাকে সত্যিকার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর ফলস্বরূপ এই প্রাক্তন C I A কর্মকর্তার এক কালের অপ্রিয় কথাবার্তাগুলোই পরবর্তীতে পশ্চিমা সাম্রাজ্য সময়ে সময়ে সত্য হতে দেখেছে।
.
আমেরিকার যু দ্ধ ও রাজনীতির ব্যাপারে মৌলিক চিন্তাধারা, লিখালিখি এবং অধ্যাপনার বাইরে বিভিন্ন ঘটনায় বিভিন্ন আলাপে মাইকেল শইয়ারের নাম উঠে এলেও বর্তমানে (২০২১) প্রায় ৭০-এর কোঠায় পা দেওয়া এই প্রবীণ বোদ্ধা আমেরিকায় তার পরিবারের সাথে ছিমছাম জীবন যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
Reviews
There are no reviews yet.