ছোটোবেলায় আমার প্রথম গল্পের বই ছিল ঈশপের গল্পসমগ্র। সেখানকার ইঁদুরের ছবিটা আমার এতো ভালো লেগেছিল যে আজ অবধি ভুলতে পারিনি। এখন নিজেই দুই সন্তানের মা। বাচ্চাদের শোয়ানোর সময় প্রতিদিন দুইটা গল্প শোনাই। একটা মজার গল্প, আরেকটা নবীদের গল্প। এই মজার গল্পের চরিত্রগুলিও খুব মজার। এসব গল্পে কখনও থাকে হাতি-ঘোড়া, কখনও ডাইনোসর, আবার কখনও ওরা নিজেরাই হয়ে যায় গল্পের এক একটা চরিত্র। কিন্তু এই মজার সব গল্পেও দেখা যায়, ডাইনোসর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলছে, খরগোশ আযান দিচ্ছে, কাঠবিড়ালি নামাজ পড়ছে। আমি কিন্তু বলে দিই না যে, নামাজ পড়া উচিত। গল্পের মাধ্যমে ওরা এমনিই শিখে যায় সবাইকেই নামাজ পড়তে হয়। অথচ এই একই জিনিস অনেক সময় বারবার বলেও বাচ্চাদেরকে শেখানো যায় না।
বাচ্চারা শুনে শেখে না, বাচ্চারা দেখে শেখে। আমার মনে আছে, একদিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। আমার কয়েক মাস বয়সী বাচ্চাটা সেদিন হিজাব ছাড়া ডাক্তারকে দেখেই কান্না করে দিলো। অথচ বোরকা পরা এক আন্টিকে প্রথমবার দেখা সত্ত্বেও ফুড়ুৎ করে উনার কোলে চলে গিয়েছিল। মা, খালা, নানুর হিজাব দেখে অভ্যস্ত বলেই হয়তো ওরা হিজাবকেই আপন ভাবে। এরকম কাহিনি বহুবার হয়েছে। দেখা যায়, যে বাড়িতে নামাজ পড়া হয়, সে বাসার বাচ্চারা আপনা থেকেই জায়নামাজে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মিছেমিছি ওযুর ভান করে৷ খেলার ছলে মসজিদে যায়। আর যে বাড়িতে নামাজ-কালামের বালাই নেই, সেখানে বাচ্চারা নামাজ পড়তে দেখলেও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই যে মুসলিমরা সালাম দিবে, ওযু করবে, নামাজ আদায় করবে, আল্লাহকে ডাকবে – এগুলো তো মুসলিম একটা বাচ্চার কাছেও স্বাভাবিক বিষয় হওয়ার কথা ছিল। মুসলিমাহ নারীরা হিজাব পালন করবে, মুসলিম পুরুষরা সিংহের কেশরের মতো দাড়ি রাখবে — এগুলো জ্ঞান ওদের জন্য হবে একদম পানির মতো সোজা। কিন্তু আজ আমরা ইসলাম থেকে এতটা দূরে অবস্থান করছি যে, ছোটোদের কথা বাদই দিলাম, বড়দেরকেও এগুলো বারবার বলে বলে বোঝাতে হচ্ছে।
এই দূরত্বের কারণ কী জানেন? আমরা ইসলামকে খালি ধর্ম-বইয়ের ভেতর আটকে ফেলেছি। আমরা ইসলামকে ভাবি নীরস একটা নিয়মনীতির বোঝা। এক তো আমাদের নিজেদের দ্বীন, নবী-রাসূল ও সাহাবীদের বীরত্বের কথাই আমাদের জানা নেই। আর দুই, আমাদের গল্পের বইগুলোর দিকে তাকান, সেখানে ইসলামের ছায়াটুকুও নেই। ছোট্ট শিশুরা বইয়ের পাতায় হিজাব দেখে না, দাঁড়ি খুঁজে পায় না। কিশোর-তরুণ বয়সে তারা পড়ে হূমায়ুন আহমেদ কিংবা জাফর ইকবালদের। সেসব কাহিনিতে কিন্তু সরাসরি লেখা থাকে না যে হুজুররা খারাপ, কিন্তু গল্পের ছলে ঠিকই আমাদের মনে মুক্তিযুদ্ধের নামে ধর্মহীনতার আদর্শ আর ঘৃণার চর্চা গেঁথে দেওয়া হয়, গল্পগুলো পড়ে মনে হতে থাকে দাঁড়ি রাখা লোকগুলোই শয়তান, রাজাকার আর মোচঁ রেখে কিংবা শাড়ি পরে ফুল দিতে যাওয়া চোশত বাংলায় কথাবলা মানুষগুলো একেকটা বিরাট দেশপ্রেমিক। তাই আমরা একটা মুসলিম নাম নিয়ে বড় হতে হতেও নিজের অজান্তেই মুসলিমদেরকে ঘৃণা করতে শিখি আর ইসলামবিদ্বেষীদের ভালোবাসতে শিখি।
ইসলামবিদ্বেষ আর ঘৃণার শৃঙ্খল থেকে যদি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে চাই তাহলে আমাদের ওদেরকে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে – কথায়, গল্পে, দারসে, কবিতায়। এজন্যই নিজের সন্তানদের জন্য এবং আমার সন্তানদের মতো সব সোনামণির জন্য চেয়েছি ওরা ইসলামকে দেখুক, দেখে শিখুক। সে চিন্তা থেকে ছোট্ট বাবুদের জন্য কিছু গল্প লিখতে চেয়েছি। না, এই বইগুলোতে ভারি ভারি ইসলামি আলাপ বা নীতিকথা নেই। কুরআনের আয়াত বা হাদিসের কথাও নেই। সম্ভবত গল্পগুলোকে প্রচলিত অর্থে “ইসলামিক গল্প” হিসেবেও আমি পরিচিত করবো না।
গল্পগুলো লেখাই হয়েছে বাচ্চাদেরকে আনন্দ দেয়ার জন্য। ওরা আনন্দ পাবে, হাসবে, খেলবে। খেলতে খেলতে মায়ের মুখে মজার মজার গল্প শুনবে, বাবার গলার স্বর মোটা করে বলা পিলে চমকানো ‘হালুম’ শুনে খিলখিল করে হেসে উঠবে, দাদু-নানুর কোলে শুয়ে-বসে আদর নিতে নিতে ছবি দেখবে, কিংবা দুপুরে ভাত খেতে খেতে বইয়ের পাতা ওল্টাবে; আর এভাবেই ওদের অন্তরে ইসলাম বাসা বানিয়ে নেবে ইনশাআল্লাহ। গল্পগুলো শুনে ওরা নিজেরাই বুঝবে, মিথ্যা বলাটা খারাপ, মিলেমিশে থাকাটা ভালো। রঙিন ছবিগুলো দেখে ওরা নিজেরাই জানবে, মায়েরা হিজাব করেন আর বাবারা দাঁড়ি রাখেন। কেউ সাহায্য করলে ওরা আপনমনেই বলবে, জাযাকাল্লাহ খাইর। নির্মল আনন্দ পেতে পেতেও বাচ্চাগুলো ইসলামকে দেখুক, অনুভব করুক, সময়গুলো রঙিন হোক — এটুকুই আমার স্বপ্ন।
Reviews
There are no reviews yet.